রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৭ অপরাহ্ন
এম আইন ফারুক আহমেদ, কালের খবর :
বুড়িগঙ্গার দখল চলছেই। কোনোভাবেই যেন থামছে না। রিকশাস্ট্যান্ড, দোকানপাট বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে চলছে দখল। সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তদারকির অভাবে এই দখল বাণিজ্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে জানান স্থানীয়রা। অপরদিকে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান ছয় মাসের মধ্যে দৃশ্যমান হবে বলে দাবি করছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। শিগগিরই প্রথম ধাপে নদীর প্রায় ২৫০ একর জমি উদ্ধারে মাঠে নামছে নদী টাস্কফোর্স।
বর্ষার স্নিগ্ধ বুড়িগঙ্গা শুষ্ক মৌসুমে এসে একেবারেই অচেনা। পার্থক্য যেন রাত আর দিনের। অবিরাম দখল-দূষণে ট্যানারি স্থানান্তরের ইতিবাচক প্রভাব যেন মিলিয়ে গেছে অযতœ-অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার ঘোর আঁধারে। ট্যানারির ৩০ শতাংশ দূষণ বন্ধ হলেও শিল্পকারখানা, আবাসিকসহ বিভিন্ন উৎসের অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ দূষণ চলছে অনেকটাই নির্বিঘেœ। সঙ্গত কারণে আবারো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে দখল-দূষণ।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, শিগগিরই প্রথম ধাপে নদীর প্রায় ২৫০ একর জমি উদ্ধারে মাঠে নামছে নদী টাস্কফোর্স। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান ছয় মাসের মধ্যে দৃশ্যমান হবে।
তিনি বলেন, এই বিষয়টিতে ইমিডিয়েটলি নজর দেয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে কমিশন যে পরামর্শ দেবে আর তা বাস্তবায়ন যারা করবে মন্ত্রণালয় কিংবা সেই সংস্থার সঙ্গে বসে কাজ করতে হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গায় চীন মৈত্রী সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে হাসনাবাদ, দোলেশ্বর ও চর মীরেরবাগ, শহীদ নগর লোহার পুলের মুখে চলছে অবাধে বুড়িগঙ্গা দখল। দোকান নির্মাণের নামে ইট, বালু, সিমেন্ট, পিট কয়লা, খোয়া, মাটি দিয়ে ভরাট চলছে কামরাঙ্গীরচর-হাজারীবাগ অংশে। ময়লা-আবার্জনা ফেলে ভরাট করা হয়েছে ব্রিজের নিচের অংশ। এদিকে লালবাগ, ইসলামবাগ এলাকায় নদীর পাড় দখল হয়েছে রিকশা স্ট্যান্ড ও ভাঙারির দোকান বসিয়ে। ড্রেজারের মাধ্যমে নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে বালু। সেই বালু শত শত ট্রাক যোগে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইট ভাটায়।
বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, যথাযথ তদারকির অভাবে নদীর তীরে গড়ে ওঠা উচ্ছেদ অভিযান ক্রমাগতভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বুড়িগঙ্গা একসময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাবে। তিনি বলেন, একসময় দেখা যাবে নদীর প্রস্থ হ্রাস পেয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে স্বাভাবিক পানি প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন তরল বর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করছে। এভাবে চলতে থাকলে বুড়িগঙ্গা এক সময় অস্তিত্ব হারাবে। জানা গেছে, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় মাত্র একটি মৌজায় ৩৩টি সীমানা পিলারের মধ্যে ৫৬টি অবৈধ ভবন গড়ে উঠেছে। ভবনগুলো ১ তলা থেকে ৭ তলা পর্যন্ত। অবৈধ ভবন উচ্ছেদ করতে গেলেই দখলদাররা কোর্টের স্টে অর্ডার নিয়ে হাজির হন। এতে থেমে যায় উচ্ছেদ কার্যক্রম।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান এম কমোডর মোজাম্মেল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বুড়িগঙ্গা দখল-দূষণরোধে কমিটি গঠন হলেও এখন পর্যন্ত কর্মপরিকল্পনাই চূড়ান্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বলেন, প্রায়ই নদীর উভয় তীরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এটি সংস্থার একটি নিয়মিত কাজ। তবে উচ্চ আদালতে মামলার কারণে এখনো বেশ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশ পেলে শিগগিরই তা ভেঙে ফেলা হবে।
মীরেরবাগের স্থানীয় বাসিন্দা শমসের আলী জানান, শুধু বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারীরাই নন, এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে চাঁদা নিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যও। এ ব্যাপারে কথা বলার উপায় নেই।
ভুক্তভোগীরা জানান, ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গেই এখানকার ব্যবসার হাত বদল হয়। এ ছাড়া অবৈধ দখলদাররা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে তাদের অবৈধ বাণিজ্য টিকিয়ে রেখেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালীরা জড়িত বলে বছরের পর বছর ধরে চলছে এই বাণিজ্য।
হাসনাবাদের ইট, বালুর গদির মালিক মোবারক হোসেন বলেন, আমরা রাস্তা ছেড়েই ব্যবসা করছি। কারো কোনো ক্ষতি করছি না। বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আমাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছে। তারপরও অভিযানের নামে প্রায়ই ঝামেলার সৃষ্টি করছে। তখন অধিক চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা নৌবন্দরের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, বুড়িগঙ্গার উভয় পাড়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। শিগগিরই অবশিষ্ট স্থাপনাগুলোও ভেঙে ফেলা হবে। ইট, বালুর গদি সরিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পরিবেশবিদ ও নদী গবেষক ড. আইনুন নিশাত বলেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলো আইনগুলো ভাঙে তারা এত শক্তিশালী যে সরকারি দফতরগুলো তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না।
আইনুন নিশাত বলেন, নদী পথে দুই পাশ থেকে দখলদারদের তুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। কারণ উচ্ছেদ অভিযানের পর পরই দখলদাররা আবার পুনঃদখল করছে। তাই উদ্ধার অভিযানের পর পরই স্থায়ীভাবে এসব স্থানে উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড করতে হবে। বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য আজ যেন ইতিহাস। নদী দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা।
ধুলা-বালিতে এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া ইট-বালুর উচ্ছিষ্ট অংশে নদীর তলদেশ দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে বহুবার উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনোটিই কাজে আসেনি। এবার বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর ৪টি নদী দখলমুক্ত করতে শিগগিরই মাঠে নামছে টাস্কফোর্স।
দৈনিক কালের খবর / কে /এল